বৈচিত্র্যময় আমের দেশ বাংলাদেশ, স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় দরকার সঠিক পদক্ষেপ
ড. মোহাম্মদ রেজওয়ান মোল্লা১
ইফতেখার আহমেদ২
আম হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন চাষাবাদকৃত একটি ফল। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী আমের উৎপত্তিস্থল ও বিস্তার নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ব্যভিলভ (১৯২৬) এর মতে আমের উৎপত্তিস্থল প্রাচীন ইন্দো-বার্মা অঞ্চল। এই অঞ্চলের অন্তর্গত হলো প্রাচীন হিমালয়ের পাদদেশ বিস্তৃত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলসমূহ। যার মধ্যে রয়েছে প্রাচীন ভারতের পূর্বাংশ, বার্মা ও আন্দামান দীপপুঞ্জ যা বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল হিসাবে বিবেচিত। আরও পূর্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, খ্রীষ্টপূর্ব ৪,০০০ বছর হতে এই সকল অঞ্চলের অন্তর্গত আসামের পাহাড়ি অঞ্চল ও আশপাশের এলাকায় আমের বন্য প্রজাতি জন্মাতে দেখা যায়।
আমের মূল উৎপত্তিস্থল ইন্দো-বার্মা অঞ্চলের অন্তর্গত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান। সে আলোকে বাংলাদেশকেও আমের উৎপত্তিস্থল (সেন্টার অব অরিজিন) বিবেচনা করা যায়। মুখার্জি (১৯৯৭) এর মত অনুযায়ী টেক্সোনোমি ও মলিকুলার তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে উত্তর পশ্চিম মায়ানমার, বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতকে আমের বিবর্তনের মূল স্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূবর্ অংশ মিয়ানমার, (প্রাচীনবার্মা) ও ভারতের পূর্বাঅঞ্চলের সহিত সংযুক্ত হওয়ায় এই অঞ্চলে আমের একটি বন্য প্রজাতি (উরীআম/খুদিআম) পাওয়া যায়। কোন ফসলের উৎপত্তিস্থল (অরিজিন) নির্ধারণের ক্ষেত্রে বন্য প্রজাতীয় প্রাপ্যতা/উপস্থিতি অন্যতম প্রধান মানদ- হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
রবিশংকর ও অন্যান্য (২০০০) ভারতকে আমের উৎপত্তিস্থল অরিজিন বিবেচনার ক্ষেত্রে আমের বৈচিত্র্যের প্রাচুর্যতাকেও মানদ- হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশেও উল্লেখযোগ্যভাবে আমের বৈচিত্র্য রয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (২০১৭) এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫২টি বিভিন্ন জাতের আমের মধ্যে প্রধানত ৩১টি সমাকৃত জাতের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য মতে প্রায় ৮টি বহুল সমাদৃত ভৌগোলিক নির্দেশক আমের জাত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ফজলি, ল্যাংরা, গোপালভোগ, খিরসাপাত, আশ্বিনা, লক্ষণভোগ, সূর্যপুরী ও হাড়িভাঙ্গা। এ সকল জাতে বিভিন্ন জিনগত বৈশিষ্ট্যের মধ্য হতে স্বাদ, গন্ধ ও অন্যান্য মানগত বৈশিষ্ট্য ঐ নির্দিষ্ট এলাকার আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল এবং এই জাতগুলোর ভৌগোলিক পরিবর্তনের কারণে এদের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোও পরবর্তিত হয়ে যায়।
বাংলাদেশের এই সকল ভৌগোলিক নির্দেশক ফসলের অবস্থান, চাষাবাদের ইতিহাস, ফসলগুলোর বিস্তারিত জিনগত বৈশিষ্ট্যায়নের (অঙ্গসংস্থানগত ও মলিকুলার) তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে অন্যদেশ কর্তৃক বায়োপাইরেসির মাধ্যমে এই সকল ফসলের স্বত্বাধিকার বা প্যাটেন্ট লাভের সুযোগ রয়েছে।
ইতোমধ্যে জামদানি, ফজলি আম, রংপুরে লাইম কে অন্য দেশ কর্তৃক ঐ দেশের সম্পদ হিসাবে স্বত্বাধিকার বা প্যাটেন্ট নেয়া হয়েছে। এই ধরনের বায়োপাইরেসি রোধকল্পে বাংলাদেশ সরকার দেরিতে হলেও আমাদের দেশীয় বিভিন্ন ফসলসহ অন্যান্য সম্পদের প্যাটেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় খিরসাপাত আমকে ডিপার্টমেন্ট অব প্যাটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড টেডমার্ক (ডিপিডিটি) কর্তৃক ভৌগোলিক নির্দেশক জাত হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ঐ ফসলের ঐ জাতের সার্বভৌম অধিকার (ঝড়াবৎবরমহ ৎরমযঃ) প্রতিষ্ঠা করবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এনএটিপি ফেজ-১ প্রকল্পের অর্থায়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) কর্তৃক বিভিন্ন ফসলের অবমুক্ত জাত এবং ওই সকল ফসলের ভৌগোলিক নির্দেশক জাতসমূহের অবস্থান, চাষাবাদের ইতিহাস, তাদের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য (অঙ্গসংস্থানগত ও মলিকুলার) সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরির লক্ষ্যে ঈযধৎধপঃবৎরুধঃরড়হ ড়ভ রসঢ়ড়ৎঃধহঃ ঢ়ষধহঃ মবহবঃরপ ৎবংড়ঁৎপবং শিরোনামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় বারি কর্তৃক উদ্ভাবিত নয়টি আমের জাতসহ নয়টি বহুল সমাদৃত ভৌগোলিক নির্দেশক জাতের অবস্থান, চাষাবাদের ইতিহাস ও বিস্তারিত বৈশিষ্ট্যায়ন (অঙ্গসংস্থানগত ও মলিকুলার) সম্পর্কিত গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। এই সকল তথ্য সম্বলিত একটি নিবন্ধ আন্তর্জাতিক সাময়িকী জার্নাল অব হর্টিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রিতে প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধনটির তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় প্রতিটি জাতের অবস্থান ও চাষাবাদের ইতিহাসের পাশাপাশি আমের ১০২টি অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে যার মধ্যে ১৫টি গাছের, ২০টি পাতার, ২২ ফুলের, ৩৩টি ফলের, ১০টি স্টোন এবং ৫টি বীজ সংক্রান্ত। এ ছাড়াও ২৫টি মাইক্রোস্যাটেলাইট মার্কারের মাধ্যমে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি জাতের স্বতন্ত্র অঙ্গসংস্থানিক ও ডিএনএ প্রোফাইল চিহ্নিত করা হয়েছে যা ঐ জাতের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিগণিত হয়। এ ছাড়াও ঐ সকল জাতগুলো জন্মস্থান সম্পর্কিত ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে এবং তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সব চেয়ে পুরাতন গাছকে বিবেচনা করা হয়। ঐ এলাকার বয়োবৃদ্ধ লোকজনের নিকট থেকে জাতটির চাষাবাদের ইতিহাস সংগ্রহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সূর্যপুরী আমের ইতিহাস সংগ্রহের উদাহরণ উল্লেখ করা যায়।
সূর্যপুরী বাংলাদেশের আমের একটি উল্লেখযোগ্য ভৌগোলিক নির্দেশক জাত। এই জাতের উৎপত্তিস্থল ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার হরিণমারি ইউনিয়নের অন্তর্গত হরিণমারি নয়াপাড়া গ্রামে। এই গ্রামের সব চেয়ে পুরানো গাছটির বয়স ২০০ বছর এবং এর বিস্তৃতি ২ একর জায়গার উপর। ধারণা করা হয় এই গাছ থেকে আশেপাশের এলাকায় এই জাতের বিস্তারলাভ করেছে। এইভাবে প্রতিটি জাতে উৎপত্তিস্থল ও চাষাবাদের ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্য এই নিবন্ধটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। যা ভবিষ্যতে এ সকল জাতের উপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণক হিসাবে বিবেচিত হবে।
সুতরাং এই নিবন্ধটি বাংলাদেশের ৯টি অবমুক্তজাত ও ৯টি ভৌগোলিক নির্দেশক জাত হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়াও আরও যে সকল সমাদৃত ও নিবন্ধিত জাত রয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও এই ধরনের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সম্বলিত প্রকাশনা প্রয়োজন, যা ভবিষ্যতে ঐ সকল জাতসমূহের উপর বাংলাদেশের জাত হিসাবে স্বত্বাধিকার লাভের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণক হিসাবে ভূমিকা পালন করতে পারে।
আম হচ্ছে একটি খুবই সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও দৃষ্টি নন্দন জনপ্রিয় ফল। সমগ্র পৃথিবী জুড়েই এর চাষাবাদ হয় তবে ট্রপিকাল ও সাবট্রপিকাল অঞ্চলের চাষাবাদ বেশি হয়। এই সকল অঞ্চলেই বিভিন্ন ধরনের আমের চাষাবাদ দেখা যায় যা বিভিন্ন শ্রেণীর ভোক্তাদের চাহিদা পূরণে ফ্রেশ ফল হিসাবে অথবা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মানুষ মৌলিক খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি অধিক পুষ্টিকর ও অন্যান্য গুণাগুণ সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণের দিকে ঝুঁকছে। এর কারণে দেশীয় জাতের পাশাপাশি কৃষি বিজ্ঞানীরা পরিবেশের সহিত খাপখাওয়ানো সম্পন্ন ও মানুষের বিভিন্ন চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন জাত উদ্ভাবন করছেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত আমের ১৪টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এই জাতগুলো বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় সমগ্রদেশে এর চাষাবাদ হচ্ছে ও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। পূর্বে এক সময় আমের উৎপাদন বৃহত্তর রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হলেও এখন দেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলেও আমের ব্যাপক চাষাবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে বারি আম-৩ এর চাষাবাদ সারাদেশ জুড়ে একটি বিপ্লব তৈরি করেছে। এ ছাড়াও আমের দীর্ঘ সময় চাহিদা সহজলভ্যতা বজায় রাখতে আমের নাবি জাত বারি আম-৪ উদ্ভাবন করেছে। মানুষের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের স্বাদের চাহিদার উপর ভিত্তি করে কাঁচামিঠা বারি আম-৯, ও দৃষ্টিনন্দন বারি আম-৭ উদ্ভাবন করেছে এবং সর্বশেষে সারা বছরব্যাপী আমের প্রাপ্যতা বজায় রাখার জন্য বারি আম-১১ উদ্ভাবন করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের আম পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হচ্ছে। ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভাবে আমের রপ্তানি আরও প্রসারিত হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি বাংলাদেশের তার নিজস্ব জাতের উপর স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বে অন্যদেশ কর্তৃক ঐ জাতের উপর তার স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করে তবে সেক্ষেত্রে নিবন্ধনকারী দেশকে বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের অংশীদারী দিতে হবে। এতে দেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হবে। তাই বাংলাদেশে আমের জনপ্রিয় দেশীয় জাতগুলো ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার দেশের স্থানীয় ও নিবন্ধিত জাতের উপর স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় অতিদ্রুত কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আমরা আশাবাদী।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১২৫৭০৪৪৩, ই-মেইল : ৎবুধিহনঃ@মসধরষ.পড়স